‘কুরআন’ শব্দের অর্থ পঠিত বা পড়া হয়েছে এমন। সূরা ইয়াসিনের প্রথম আয়াতে
কুরআনকে বলা হয়েছে- ‘প্রজ্ঞাময়’ এবং সূরা আর রাহমানের শুরুতে ঘোষণা করা
হয়েছে- ‘করুণাময় আল্লাহ কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন; তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন
এবং তাকে ভাষা শিখিয়েছেন।’ সূরা বাকারাতে বলা হয়েছে- ‘কুরআন এমন একটি
গ্রন্থ যার মধ্য কোনো ভুল নেই।’ এই প্রজ্ঞাময় বিশুদ্ধ গ্রন্থটি কিভাবে পড়তে
হবে,
কেন পড়তে হবে, সে ব্যাপারে সাধারণভাবে আল্লাহর পক্ষ থেকে আবার তার নিয়মও বলে দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘ওয়ার্তিলেল কুরআনা তারতিলা’ অর্থাৎ কুরআনকে শুদ্ধ বা সঠিক উচ্চারণে পড়তে হবে। কেননা সঠিক উচ্চারণে কুরআন পড়লে কুরআনের শব্দ ও অর্থ বুঝতে পারা সহজ হবে। আমরা যদি খেয়াল করি তাহলে দেখব যে, পৃথিবীর প্রায় বেশির ভাগ প্রসিদ্ধ ভাষারই ব্যাকরণ আছে। আর এসব ব্যাকরণে ঢ়যড়হবঃরপ বা ধ্বনিতত্ত্ব নামক একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ও রয়েছে। ব্যাকরণের এই অধ্যায়টি ভাষার ভেতরে শব্দের উচ্চারণ বা ধ্বনিত্রুটি সমাধানের কৌশল নিয়ে আলোচনা করে থাকে; যাতে মানুষ তার ব্যবহারকৃত ভাষার সমুচ্চারিত শব্দ বা কাছাকাছি উচ্চারিত শব্দের সঠিক উচ্চারণটা করতে পারেন। কেননা প্রায় একই রকম উচ্চারিত শব্দের অর্থ ভিন্ন রকম হয়ে থাকে। যেমন আরবি ভাষায় বড় ক্বাফ ও ছোট কাফ ধ্বনি যোগে গঠিত দু’টি শব্দ যথাক্রমে ‘ক্কুল’ ও ‘কুল’।
এই দু’টি শব্দ উচ্চারণে বা ধ্বনিগত তারতম্যে ভিন্ন হলেও শুনতে প্রায় একই রকম শুনায় কিন্তু অর্থে দু’টির মধ্যে বিস্তর পার্থক্য আছে। প্রথম ‘ক্কুল’ শব্দের অর্থ হলো ‘বলা’ যেমন, ‘ক্কুল হু আল্লাহ হু আহাদ’ অর্থাৎ বলো আল্লাহ এক। আর দ্বিতীয় ‘কুল’ অর্থ হলো ‘প্রত্যেক’ যেমন- ‘কুল্লু নাফসুন যায়েকাতুল মওত’ অর্থাৎ ‘প্রতিটি বা প্রত্যেক আত্মা মরণশীল’। সব ভাষাতেই এ রকম অজস্র সমুচ্চারিত শব্দ রয়েছে। সে জন্যই উচ্চারণ ঠিক করে কুরআন পড়া গুরুত্ববহ যাতে অর্থের বিকৃতি না ঘটে। এসব দিক বিবেচনা করে বলা হয়েছে, শব্দ ও অর্থ উভয়কে ঠিক রেখেই কুরআন পড়া জরুরি। ধ্বনি হচ্ছে একটি ভাষার প্রাণ। ধ্বনি পরিবর্তন ঘটলে শব্দ এবং অর্থ দুটোরই পরিবর্তন হয়; ভাষারও মৌলিক পরিবর্তন ঘটে। কাজেই কুরআন পড়ার সময় সঠিক ধ্বনিতে কুরআন পড়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
অর্থবিচারে কুরআন পড়া দু’ধরনের হয়ে থাকে। এক. তাযাক্কুরে কুরআন এবং দুই. তাদাক্কুরে কুরআন। তাযাক্কুরে কুরআন হলো কুরআনের আয়াতগুলোর ভাসা ভাসা অর্থ বুঝে কুরআন পড়া। অর্থাৎ কোনো প্রকারে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ছাড়াই সরল অর্থ বোঝার চেষ্টা করে কুরআন পড়া। আর তাদাক্কুরে কুরআন হলো কুরআন পড়ার সময় শব্দ ও অর্থের চিন্তা করে, শব্দের প্রকৃতি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে প্রাসঙ্গিক ও আনুষঙ্গিক বিষয়কে উপলব্ধিতে এনে অর্থ উদ্ধার করে করে কুরআন পড়া। অর্থাৎ এভাবে কুরআন পড়ার সাথে চিন্তার ব্যাপ্তি থাকবে। কেউ হয়তো আরবি কুরআন পড়তে পারেন না; তার উচিত হবে তিনি যে ভাষা সবচেয়ে ভালো বোঝেন সেই ভাষায় অনুবাদকৃত কুরআন পড়া। তবে খেয়াল রাখতে হবে, যে ভাষাতেই অনুবাদকৃত কুরআনই পড়া হোক না কেন দেখতে হবে সেই কুরআনে যেন মূল আরবি আয়াতগুলো থাকে এবং অনুবাদকৃত ভাষায় মূল আরবি হরফের উচ্চারণ থাকে, পাশাপাশি অর্থেরও অনুবাদ থাকে; এমনটি হলে সবচেয়ে ভালো হয়। কেননা আরবি কুরআনকে অবিকৃত রেখে অনুবাদ পড়া অত্যাবশ্যক।
‘কুরআন’ আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজিলকৃত মহাগ্রন্থ। এই গ্রন্থটিকে মানব জাতির হেদায়েতের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। সুতরাং এটি পড়তে হবে এবং এই মূল্যবান গ্রন্থটি পড়লে পুণ্য হবে এমন উদ্দেশ্যের ভেতর সীমাবদ্ধ থেকে কুরআন পড়লে কুরআন পড়ার মৌলিকত্ব অপূর্ণই থেকে যাবে। অর্থাৎ কুরআন শুধু পড়ার জন্যই পড়তে হবে এমন প্রত্যাশা করা বাঞ্ছনীয় নয়। মনে রাখা জরুরি যে, কুরআন অবতীর্ণের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানবগোষ্ঠীকে শান্তিময় জীবনে পরিচালিত করা। মানুষের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, রাষ্ট্রনৈতিক জীবন ও অর্থনৈতিক জীবন কেমনভাবে পরিচালিত হবে তার দিক নির্দেশনা বর্ণনা করা হয়েছে পবিত্র কুরআনে। আর এসব বিষয় অবগত হওয়ার জন্যই কুরআন পড়া আবশ্যক। মুসলিম পরিবারের শিশুরা যখন অ আ ক খ পড়া শিখতে শুরু করে তখনই আরবি কুরআন পড়া শিক্ষা নেয়াও জরুরি। মাদরাসার ছাত্ররা যখন মাদরাসা থেকে সর্বশেষ ডিগ্রি নিয়ে বের হয়ে আসেন তখন তিনি কুরআন পড়া আয়ত্ত তো করেনই সেই সাথে কুরআন-হাদিসের জ্ঞানে আলোকিত মানুষ হিসেবেই সমাজে বিচরণ করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, বাংলাদেশের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা বেশির ভাগ মানুষ ছাত্রজীবন তো বটেই কর্মজীবনও শেষ করে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বৃদ্ধ বয়সে এসে কুরআন শেখার চেষ্টা করে থাকেন। অথচ কুরআন পড়ার দরকার ছিল পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে এবং সেই সাথে সর্বপ্রকার কর্মজীবনে অনুপ্রবেশের আগেই। যাতে কুরানের শিক্ষা ও বিধানকে সমাজে বাস্তবায়ন করা যায়। দুঃখের বিষয়, আমাদের সমাজে অবহেলায় এ রকম একটি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়।
ভারত উপমহাদেশের বেশির ভাগ মানুষ কুরআনকে ঘরের তাকে রেখে দেন, পড়েন না। কেউ কেউ কুরআনকে ঘরের ভেতরে এত উঁচু জায়গায় এমনভাবে রেখে দেন যে, যখন পড়ার দরকার পড়ে তখন চেয়ার বা উঁচু টুলের ওপর চড়ে তারপর নামাতে হয়। এ রকম উঁচু স্থানে কুরআন শরিফকে রাখতে পেরে ভাবা হয় যে, কুরআনের সম্মান ও মর্যাদা সমুন্নত করা হলো। সব বস্তুর ওপরে কুরআনকে রেখে কুরআনের প্রতি যে সম্মান প্রদর্শন করা হয় তার চেয়ে বেশি সম্মান দেখানো হবে যদি মানবজীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে কুরআনকে রাখা যায়। কখনো কখনো কুরআনকে এত বেশি দিন তাকের ওপর বা আলমারি কিংবা বুকসেলফে রাখা হয় যে তার ওপর ধুলাবালুর স্তর পড়ে যায়। এভাবে রাখা কুরআন শরিফ যখন কেউ মারা যায় তখন ঝেড়েমুছে নিয়ে এসে মৃত ব্যক্তির পাশে পড়ানো হয়। পড়া শেষ হলে আবার যেখানে ছিল সেখানেই তুলে রাখা হয়। এই হচ্ছে আমাদের সমাজে কুরআন পড়ার চর্চা। আবার কেউ কেউ কুরআন পড়ার উদ্দেশ্যে নিজের মধ্যে খামাখা জটিলতা সৃষ্টি করেন এবং নিজে নিজেই অযথা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ওঠেন। ভাবেন, চেয়ারে বসে কুরআন পড়া যাবে কি না; জুতা পায়ে কুরআন পড়া বেয়াদবি হবে কি না; কুরআন পড়তে গিয়ে মাথায় টুপি দিতে হবে কি না; অজু গোসল ছাড়া কুরআন ছোঁয়ার বিধান আছে কি না; অফিসের টেবিলে কুরআন রাখা ও সেখানে বসে পড়া যায় কি না ইত্যাদি অদরকারি বিষয়াদির চিন্তা করতে করতে শেষ পর্যন্ত আর কুরআন পড়াই হয়ে ওঠে না। একশ্রেণীর মানুষ কুরআনকে অতি সম্মান দেখাতে গিয়ে এই মূল্যবান গ্রন্থকে আমাদের সমাজে অস্পর্শ গ্রন্থ হিসেবে পরিচিত করার ধারণা সৃষ্টি করেছে। স্মরণ রাখা দরকার, কুরআন পড়তে বসার নির্ভুল আয়োজনের চেয়ে কুরআন পড়া জরুরি। কুরআনকে হাতের কাছে পাওয়া যায়, এ রকম সহজ জায়গায় রাখতে হবে এবং সময় পেলেই তা পড়তে হবে। হাতের মোবাইল ফোনে, ল্যাপটপে, কম্পিউটারে অডিও মেমোরিতে তরজমাসহ কুরআন তেলাওয়াত রেখে তা সময়ে সময়ে শুনে বোঝার চেষ্টা করাও কুরআন পড়ার মধ্যে গণ্য হতে পারে। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় শিশুশ্রেণী থেকে শুরু করে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পর্যন্ত কুরআন পড়া অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি- যাতে করে মানুষকে আলাদা করে শিক্ষক রেখে কুরআন পড়া শিখতে না হয়। জ্ঞান অর্জনের জন্যই পড়তে হয়। আর সঠিক, নির্ভেজাল ও প্রজ্ঞাময় জ্ঞানের একমাত্র উৎসই হচ্ছে পবিত্র কুরআন। এই গ্রন্থটি নিয়মিত পড়ার মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান যত মানুষের ব্যবহারিক জীবনে কাজে লাগানো যাবে, আশা করা যায় সমাজ ততই উন্নত হতে থাকবে।
লেখক : গবেষক
কেন পড়তে হবে, সে ব্যাপারে সাধারণভাবে আল্লাহর পক্ষ থেকে আবার তার নিয়মও বলে দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘ওয়ার্তিলেল কুরআনা তারতিলা’ অর্থাৎ কুরআনকে শুদ্ধ বা সঠিক উচ্চারণে পড়তে হবে। কেননা সঠিক উচ্চারণে কুরআন পড়লে কুরআনের শব্দ ও অর্থ বুঝতে পারা সহজ হবে। আমরা যদি খেয়াল করি তাহলে দেখব যে, পৃথিবীর প্রায় বেশির ভাগ প্রসিদ্ধ ভাষারই ব্যাকরণ আছে। আর এসব ব্যাকরণে ঢ়যড়হবঃরপ বা ধ্বনিতত্ত্ব নামক একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ও রয়েছে। ব্যাকরণের এই অধ্যায়টি ভাষার ভেতরে শব্দের উচ্চারণ বা ধ্বনিত্রুটি সমাধানের কৌশল নিয়ে আলোচনা করে থাকে; যাতে মানুষ তার ব্যবহারকৃত ভাষার সমুচ্চারিত শব্দ বা কাছাকাছি উচ্চারিত শব্দের সঠিক উচ্চারণটা করতে পারেন। কেননা প্রায় একই রকম উচ্চারিত শব্দের অর্থ ভিন্ন রকম হয়ে থাকে। যেমন আরবি ভাষায় বড় ক্বাফ ও ছোট কাফ ধ্বনি যোগে গঠিত দু’টি শব্দ যথাক্রমে ‘ক্কুল’ ও ‘কুল’।
এই দু’টি শব্দ উচ্চারণে বা ধ্বনিগত তারতম্যে ভিন্ন হলেও শুনতে প্রায় একই রকম শুনায় কিন্তু অর্থে দু’টির মধ্যে বিস্তর পার্থক্য আছে। প্রথম ‘ক্কুল’ শব্দের অর্থ হলো ‘বলা’ যেমন, ‘ক্কুল হু আল্লাহ হু আহাদ’ অর্থাৎ বলো আল্লাহ এক। আর দ্বিতীয় ‘কুল’ অর্থ হলো ‘প্রত্যেক’ যেমন- ‘কুল্লু নাফসুন যায়েকাতুল মওত’ অর্থাৎ ‘প্রতিটি বা প্রত্যেক আত্মা মরণশীল’। সব ভাষাতেই এ রকম অজস্র সমুচ্চারিত শব্দ রয়েছে। সে জন্যই উচ্চারণ ঠিক করে কুরআন পড়া গুরুত্ববহ যাতে অর্থের বিকৃতি না ঘটে। এসব দিক বিবেচনা করে বলা হয়েছে, শব্দ ও অর্থ উভয়কে ঠিক রেখেই কুরআন পড়া জরুরি। ধ্বনি হচ্ছে একটি ভাষার প্রাণ। ধ্বনি পরিবর্তন ঘটলে শব্দ এবং অর্থ দুটোরই পরিবর্তন হয়; ভাষারও মৌলিক পরিবর্তন ঘটে। কাজেই কুরআন পড়ার সময় সঠিক ধ্বনিতে কুরআন পড়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
অর্থবিচারে কুরআন পড়া দু’ধরনের হয়ে থাকে। এক. তাযাক্কুরে কুরআন এবং দুই. তাদাক্কুরে কুরআন। তাযাক্কুরে কুরআন হলো কুরআনের আয়াতগুলোর ভাসা ভাসা অর্থ বুঝে কুরআন পড়া। অর্থাৎ কোনো প্রকারে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ছাড়াই সরল অর্থ বোঝার চেষ্টা করে কুরআন পড়া। আর তাদাক্কুরে কুরআন হলো কুরআন পড়ার সময় শব্দ ও অর্থের চিন্তা করে, শব্দের প্রকৃতি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে প্রাসঙ্গিক ও আনুষঙ্গিক বিষয়কে উপলব্ধিতে এনে অর্থ উদ্ধার করে করে কুরআন পড়া। অর্থাৎ এভাবে কুরআন পড়ার সাথে চিন্তার ব্যাপ্তি থাকবে। কেউ হয়তো আরবি কুরআন পড়তে পারেন না; তার উচিত হবে তিনি যে ভাষা সবচেয়ে ভালো বোঝেন সেই ভাষায় অনুবাদকৃত কুরআন পড়া। তবে খেয়াল রাখতে হবে, যে ভাষাতেই অনুবাদকৃত কুরআনই পড়া হোক না কেন দেখতে হবে সেই কুরআনে যেন মূল আরবি আয়াতগুলো থাকে এবং অনুবাদকৃত ভাষায় মূল আরবি হরফের উচ্চারণ থাকে, পাশাপাশি অর্থেরও অনুবাদ থাকে; এমনটি হলে সবচেয়ে ভালো হয়। কেননা আরবি কুরআনকে অবিকৃত রেখে অনুবাদ পড়া অত্যাবশ্যক।
‘কুরআন’ আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজিলকৃত মহাগ্রন্থ। এই গ্রন্থটিকে মানব জাতির হেদায়েতের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। সুতরাং এটি পড়তে হবে এবং এই মূল্যবান গ্রন্থটি পড়লে পুণ্য হবে এমন উদ্দেশ্যের ভেতর সীমাবদ্ধ থেকে কুরআন পড়লে কুরআন পড়ার মৌলিকত্ব অপূর্ণই থেকে যাবে। অর্থাৎ কুরআন শুধু পড়ার জন্যই পড়তে হবে এমন প্রত্যাশা করা বাঞ্ছনীয় নয়। মনে রাখা জরুরি যে, কুরআন অবতীর্ণের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানবগোষ্ঠীকে শান্তিময় জীবনে পরিচালিত করা। মানুষের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, রাষ্ট্রনৈতিক জীবন ও অর্থনৈতিক জীবন কেমনভাবে পরিচালিত হবে তার দিক নির্দেশনা বর্ণনা করা হয়েছে পবিত্র কুরআনে। আর এসব বিষয় অবগত হওয়ার জন্যই কুরআন পড়া আবশ্যক। মুসলিম পরিবারের শিশুরা যখন অ আ ক খ পড়া শিখতে শুরু করে তখনই আরবি কুরআন পড়া শিক্ষা নেয়াও জরুরি। মাদরাসার ছাত্ররা যখন মাদরাসা থেকে সর্বশেষ ডিগ্রি নিয়ে বের হয়ে আসেন তখন তিনি কুরআন পড়া আয়ত্ত তো করেনই সেই সাথে কুরআন-হাদিসের জ্ঞানে আলোকিত মানুষ হিসেবেই সমাজে বিচরণ করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, বাংলাদেশের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা বেশির ভাগ মানুষ ছাত্রজীবন তো বটেই কর্মজীবনও শেষ করে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বৃদ্ধ বয়সে এসে কুরআন শেখার চেষ্টা করে থাকেন। অথচ কুরআন পড়ার দরকার ছিল পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে এবং সেই সাথে সর্বপ্রকার কর্মজীবনে অনুপ্রবেশের আগেই। যাতে কুরানের শিক্ষা ও বিধানকে সমাজে বাস্তবায়ন করা যায়। দুঃখের বিষয়, আমাদের সমাজে অবহেলায় এ রকম একটি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়।
ভারত উপমহাদেশের বেশির ভাগ মানুষ কুরআনকে ঘরের তাকে রেখে দেন, পড়েন না। কেউ কেউ কুরআনকে ঘরের ভেতরে এত উঁচু জায়গায় এমনভাবে রেখে দেন যে, যখন পড়ার দরকার পড়ে তখন চেয়ার বা উঁচু টুলের ওপর চড়ে তারপর নামাতে হয়। এ রকম উঁচু স্থানে কুরআন শরিফকে রাখতে পেরে ভাবা হয় যে, কুরআনের সম্মান ও মর্যাদা সমুন্নত করা হলো। সব বস্তুর ওপরে কুরআনকে রেখে কুরআনের প্রতি যে সম্মান প্রদর্শন করা হয় তার চেয়ে বেশি সম্মান দেখানো হবে যদি মানবজীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে কুরআনকে রাখা যায়। কখনো কখনো কুরআনকে এত বেশি দিন তাকের ওপর বা আলমারি কিংবা বুকসেলফে রাখা হয় যে তার ওপর ধুলাবালুর স্তর পড়ে যায়। এভাবে রাখা কুরআন শরিফ যখন কেউ মারা যায় তখন ঝেড়েমুছে নিয়ে এসে মৃত ব্যক্তির পাশে পড়ানো হয়। পড়া শেষ হলে আবার যেখানে ছিল সেখানেই তুলে রাখা হয়। এই হচ্ছে আমাদের সমাজে কুরআন পড়ার চর্চা। আবার কেউ কেউ কুরআন পড়ার উদ্দেশ্যে নিজের মধ্যে খামাখা জটিলতা সৃষ্টি করেন এবং নিজে নিজেই অযথা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ওঠেন। ভাবেন, চেয়ারে বসে কুরআন পড়া যাবে কি না; জুতা পায়ে কুরআন পড়া বেয়াদবি হবে কি না; কুরআন পড়তে গিয়ে মাথায় টুপি দিতে হবে কি না; অজু গোসল ছাড়া কুরআন ছোঁয়ার বিধান আছে কি না; অফিসের টেবিলে কুরআন রাখা ও সেখানে বসে পড়া যায় কি না ইত্যাদি অদরকারি বিষয়াদির চিন্তা করতে করতে শেষ পর্যন্ত আর কুরআন পড়াই হয়ে ওঠে না। একশ্রেণীর মানুষ কুরআনকে অতি সম্মান দেখাতে গিয়ে এই মূল্যবান গ্রন্থকে আমাদের সমাজে অস্পর্শ গ্রন্থ হিসেবে পরিচিত করার ধারণা সৃষ্টি করেছে। স্মরণ রাখা দরকার, কুরআন পড়তে বসার নির্ভুল আয়োজনের চেয়ে কুরআন পড়া জরুরি। কুরআনকে হাতের কাছে পাওয়া যায়, এ রকম সহজ জায়গায় রাখতে হবে এবং সময় পেলেই তা পড়তে হবে। হাতের মোবাইল ফোনে, ল্যাপটপে, কম্পিউটারে অডিও মেমোরিতে তরজমাসহ কুরআন তেলাওয়াত রেখে তা সময়ে সময়ে শুনে বোঝার চেষ্টা করাও কুরআন পড়ার মধ্যে গণ্য হতে পারে। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় শিশুশ্রেণী থেকে শুরু করে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পর্যন্ত কুরআন পড়া অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি- যাতে করে মানুষকে আলাদা করে শিক্ষক রেখে কুরআন পড়া শিখতে না হয়। জ্ঞান অর্জনের জন্যই পড়তে হয়। আর সঠিক, নির্ভেজাল ও প্রজ্ঞাময় জ্ঞানের একমাত্র উৎসই হচ্ছে পবিত্র কুরআন। এই গ্রন্থটি নিয়মিত পড়ার মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান যত মানুষের ব্যবহারিক জীবনে কাজে লাগানো যাবে, আশা করা যায় সমাজ ততই উন্নত হতে থাকবে।
লেখক : গবেষক